গল্পগুচ্ছ | Galpo Guchcha

বই থেকে নমুনা পাঠ্য (মেশিন অনুবাদিত)

(Click to expand)
ঘাটের কথা ৩ SS | তাহার মা তাহাকে বলিত কুস্মি | যখন-তখন দেখিতাম, কুসুম জলের ধারে বসিয়া আছে | জলের সঙ্গে তাহার হৃদয়ের সঙ্গে বিশেষ যেন কী মিল ছিল ৷ সে জল ভারি ভালোবাসিত | কিছুদিন পরে কুসুমকে আর দেখিতে পাই না । ভুবন আর স্বর্ণ ঘাটে আসিয়া কাদিত | শুনিলাম, তাহাদের কুসি-খুশি-রাক্তুসিকে শ্বশুরবাড়ি লইয়া গিয়াছে | শুনিলাম, যেখানে তাহাকে লইয়া গেছে সেখানে নাকি গঙ্গা নাই৷ সেখানে আবার কারা সব নূতন লোক, নূতন ঘরবাড়ি, নূতন পথঘাট | জলের ATH কে যেন. ডাঙায় রোপণ করিতে লইয়া গেল | ক্রমে কুসুমের কথা একরকম ভুলিয়া গেছি । এক বৎসর হইয়া গেছে | ঘাটের মেয়েরা কুসুমের গল্পও বড়ো করে না'। একদিন সন্ধ্যার সময়ে বহুকালের পরিচিত পায়ের স্পর্শে সহসা যেন চমক লাগিল | মনে হইল যেন কুসুমের পা | তাহাই বটে, কিন্তু সে পায়ে আর মল বাজিতেছে না । সে পায়ের সে সংগীত নাই । কুসুমের পায়ের স্পর্শ ও মলের শব্দ চিরকাল একত্র অনুভব করিয়া আসিতেছি- আজ সহসা সেই মলের শব্দটি না শুনিতে পাইয়া সন্ধ্যাবেলাকার জলের কল্লোল কেমন বিষণ্ন শুনাইতে লাগিল, GAA মধ্যে পাতা ঝর্ঝর্‌ করিয়া বাতাস কেমন হা-হা করিয়া উঠিল | কুসুম বিধবা হইয়াছে | শুনিলাম, তাহার স্বামী বিদেশে চাকরি করিত; দুই-একদিন ছাড়া স্বামীর সহিত সাক্ষাতই হয় নাই | পত্রযোগে বৈধব্যের সংবাদ পাইয়া, আট বৎসর বয়সে মাথার সিদুর মুছিয়া, গায়ের গহনা ফেলিয়া, আবার তাহার দেশে সেই গঙ্গার ধারে ফিরিয়া আসিয়াছে । কিন্তু তাহার সঙ্গিনীদেরও বড়ো কেহ নাই | ভূবন স্বর্ণ অমলা শ্বশুরঘর করিতে গিয়াছে | কেবল শরৎ আছে, কিন্তু শুনিতেছি অগ্রহায়ণ মাসে তাহারও বিবাহ হইয়া যাইবে | কুসুম fore একলা . পাঁড়িয়াছে | কিন্তু, সে যখন দুটি হাটুর উপর মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া আমার ধাপে বসিয়া থাকিত তখন আমার মনে হইত, যেন নদীর ঢেউগুলি সবাই মিলিয়া হাত তুলিয়া .তাহাকে কুসি-খুশি-রাক্তুসি বলিয়া ডাকাডাকি করিত | বর্ষার SACS গঙ্গা যেমন প্রতিদিন দেখিতে দেখিতে ভরিয়া উঠে, কুসুম তেমনি দেখিতে দেখিতে প্রতিদিন সৌন্দর্যে যৌবনে ভরিয়া উঠিতে লাগিল | কিন্তু তাহার মলিন বসন, করুণ মুখ, শান্ত স্বভাবে তাহার যৌবনের উপর এমন একটি ছায়াময় আবরণ রচনা করিয়া দিয়াছিল যে, সে যৌবন, সে বিকশিত রূপ সাধারণের চোখে পড়িত না | কুসুম যে বড়ো হইয়াছে এ যেন কেহ দেখিতে পাইত না । আমি তো পাইতাম a | আমি কুসুমকে সেই বালিকাটির চেয়ে বড়ো কখনো দেখি নাই | তাহার মল ছিল না বটে, কিন্তু সে যখন চলিত আমি সেই মলের শব্দ শুনিতে পাইতাম | এমনি করিয়া দশ বৎসর কখন কাটিয়া গেল, গায়ের লোকেরা কেহ যেন জানিতেই পারিল না | এই আজ. যেমন দেখিতেছ, সে বৎসরও ভাদ্র মাসের শেষাশেষি এমন এক দিন আসিয়াছিল | তোমাদের প্রপিতামহীরা সেদিন সকালে উঠিয়া এমনিতরো মধুর সূর্যের আলো দেখিতে পাইয়াছিলেন | তাহারা যখন এতখানি ঘোমটা টানিয়া কলসী তুলিয়া লইয়া আমার উপরে প্রভাতের আলো আরো আলোময় করিবার জন্য গাছপালার মধ্য দিয়া গ্রামের উচুনিচু রাস্তার ভিতর দিয়া গল্প করিতে করিতে চলিয়া আসিতেন তখন তোমাদের সম্ভাবনাও তাহাদের মনের এক পার্কে উদিত হইত না। তোমরা যেমন ঠিক মনে করিতে পার না, তোমাদের দিদিমারাও সত্যসত্যই একদিন খেলা করিয়া বেড়াইতেন, আজিকার দিন যেমন সত্য, যেমন জীবন্ত, সেদিনও ঠিক তেমনি সত্য ছিল, তোমাদের মতো তরুণ হৃদয়খানি লইয়া সুখে দুঃখে তাহারা তোমাদেরই মতো টলমল করিয়া দুলিয়াছেন, তেমনি আজিকার এই শরতের দিন-_ তাহারা-হীন, তাহাদের সুখদুঃখের-স্মৃতিলেশমাত্র-হীন আজিকার এই শরতের সূর্যকরোজ্জ্বল আনন্দচ্ছবি-- তাহাদের কল্পনার নিকটে তদপেক্ষাও অগোচর ছিল |



Leave a Comment